মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এদেশের ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় আলোচিত নাম। তিনি নাটক বানিয়েছেন অন্যরকম করে। ছবিও বানিয়েছেন আলাদা রকম। তবে তার বিপক্ষে অভিযোগও কম নয়। তিনি এখন ব্যস্ত নতুন ছবি ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ নিয়ে। এবারের সাক্ষাৎকারে সরয়ার ফারুকী নানা বিষয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন লতিফুল হক-এর সঙ্গে।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ছবির পর তো ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘আই হেইট মাই মাদার’ বানাবেন। সেখান থেকে হঠাৎ ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ কেন?
আসলে সব সময়ই মাথার মধ্যে বিভিন্ন গল্প ঘুরতে থাকে। তার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশী যন্ত্রণা করে সেটাই শুরু করে দেই। এই গল্পটাই বেশী যন্ত্রণা করেছে তো। তাই এটাই বানাচ্ছি...!
আপনার ‘ব্যাচেলর’ ছবির গান তো দারুণ পছন্দ করেছিল সবাই। তারপরের ছবিতে অবশ্য গান ছিল না। এবার কী হবে?
এবার গান থাকছে। তবে ব্যাচেলরের মতোই ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে। এবার গাইছেন এসআই টুটুল, হাবিব, ন্যান্সি, ফুয়াদ, সুমন, অনিলা, তপুসহ আরো অনেকে।
ইদানিং টিভিতে আপনার কাজ কমে গেছে।
কোথায়? ৪২০ তো শেষ হল কিছুদিন আগে। আসলে আমি সবসময়ই সিনেমা বানাতে চেয়েছি। পারিনি, তাই টিভির জন্য কাজ করেছি।
আপনার প্রথম নাটক প্রচারিত হয় ’৯৯ সালে। তারপর ১০ বছর গেল। এতদিনের কাজ নিয়ে কি সন্তুষ্ট ?
প্রথমেই বলি, আমি কোন নাটক বানাইনি। টিভিতে যা গেছে তাকে আমি বলি ‘ভিডিও ফিল্ম।’ আর কাজ নিয়ে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। কারণ, আমি যা বানাতে চেয়েছিলাম সবক্ষেত্রেই সেটার কাছাকাছি গিয়েছি।
কাছাকাছি! পুরোটা কেন নয়?
সবকিছু কি আর পুরোপুরি হয়? একদম পারফেক্ট হয়ে গেলে তো আর কিছুই করার থাকবে না।
সিনেমা বানানোর স্বপ্ন কেন দেখেছিলেন?
আসলে ’৯৩ কী ’৯৪ সালের দিকে বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটিতে আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রচুর ফিল্ম দেখতাম। অনুপ্রেরণাটা সেখান থেকেই এসেছে।
কোন বিশেষ ছবি থেকে কি?
না। কোন একটা ছবি থেকে নয় বরং অনেক অনেক ছবি মিলিয়ে এই অনুপ্রেরণা। তবে পরিচালকদের কথা যদি বলেন তো বলতে পারি।
বলেন।
মজিদ মাজেদি, ওজু, ফেলিনি, তারকোভস্কি ...এরকম আরো অনেকই আছেন।
বিভিন্ন সময়ে আপনি ইরানি ছবির প্রতি মুগ্ধতার কথা বলেছেন। এটা কেন?
ট্রুথ। ইরানি ছবিতে আমি সত্যতা, জীবনঘনিষ্ঠতা খুঁজে পাই।
আমাদের দেশে যারা সিনেমা বানান তাদের অনেকেই আর্থিক সঙ্কটের কথা বলেন। কিন্তু ইরানি ছবিও তো খুবই অল্প বাজেটের?
আসলে ছবির সঙ্গে টাকার কোন সম্পর্ক নেই। ছবি বানাতে টাকার চেয়ে বেশি দরকার মেধা। আর যারা টাকার কথা বলেন তারা তাদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই বলেন। আপনার যদি টাকা না থাকে সেক্ষেত্রে প্রযুক্তি সীমাবদ্ধতা হতে পারে। আপনি ডিজিটালে না বানিয়ে ৩৫ মিলিমিটারে ছবি বানান। টাকার জন্য ছবি তো আর আটকাচ্ছে না।
এবার আপনার শুরুর গল্পে আসি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী হিসেবে শুরুটা কতটা কঠিন ছিল ?
সবকিছুই তখন বিপরীত ছিল। এমনকি ১৯৯৯ তে যখন আমি ‘ওয়েটিং রুম’ বানাই প্রথমবার কিন্তু সেটা বাতিল হয়ে যায়। একুশে টেলিভিশনে জমা দেবার পর আমাকে জানানো হল সেটা বাতিল হয়ে গেছে। আমি তো ভেবে নিলাম পরিচালক হিসেবে আমার এখানেই ইতি। তার বেশ কিছুদিন পরে ইটিভি কর্তৃপক্ষ ছবিটি আবার দেখে এবং আমাকে জানায় যে ‘ওয়েটিং রুম’ প্রচারিত হচ্ছে।
সেই তো শুরু। তার পর টিভিতে একের পর আপনি ছবি বানিয়েছেন। সেগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে এবং অনেকে বলেন, আপনার হাত দিয়ে নতুন একটা ধারাও তৈরী হয়েছে। তাই তো ?
এটা ঠিক যে, আমার কাজগুলো মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখেছে। দর্শকরা দেশীয় চ্যানেলমুখী হয়েছে।
কিন্তু এখন অনেকেই বলেছেন, আপনার কাজগুলো একই রকম হয়ে যাচ্ছে। সব কাজই এক ধরণের প্যার্টানে বন্দী।
এটা আসলে যারা আমাকে পছন্দ করে না তারাই বলে। আমাকে গালি দেয়ার কিছু না পেয়েই এটা বলে। আপনি যদি আমার শেষ কাজগুলোও দেখেন যেমন-‘ওয়েটিং রুম-২’, ‘স্পার্টাকাস-৭১’ ‘উনমানুষ’ ‘ইন্টারভিউ’ কিংবা ‘৪২০’-কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই মিল নেই। আর ভালো পরিচালকের কাজে তার সাক্ষর থাকবেই। কিয়ারুস্তমির ছবি দেখলে বোঝা যাবে এটা তার। এটা দোষের কিছু না।
আপনার কাজগুলোতে ভাষার ব্যবহার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আপনি নিজে বহুবার এর উত্তর দিয়েছেন, পত্রিকাতেও লিখেছেন। এ ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে জোরালো যুক্তি কী?
ভাষা কিন্তু কোন স্মৃতিসৌধের বেদির মতো অটল জিনিস না। ‘ভাষা বহতা নদীর মতো’- এটা মুখে আমরা যতই বলি মনে বিশ্বাস করি না। বাংলা ভাষা কলি যুগে যে চেহারায় ছিল, ফোর্ট উইলিয়ামের কালে সেখানে ছিল না। আবার রবীন্দ্রনাথের কালেও সেখান থেকে সরে এসেছে। ভাষার বিবর্তন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এর বড় অনুঘটক মানুষের মুখের ভাষা, কথ্য ভাষা। এই কথ্য ভাষা আমার ছবিতে এসেছে ছবির প্রয়োজনেই।
কিন্তু এটা সব কাজেই কেন?
আমার সব কাজে কিন্তু এটা ছিল না। যে ‘৫১বর্তী’ নিয়ে এত কথা সেখানেও প্রমিত বাংলা আছে, ‘ওয়েটিং রুমে’ ও আছে। আসলে ভাষার ব্যবহার হয়েছে পরিস্থিতি অনুযায়ী। একজন যখন রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলে এখন এক ধরণের ভাষার ব্যবহার করে। আবার যখন সে কাউকে প্রোপজ করতে যায় তখন কিন্তু প্রমিত বাংলার আশ্রয় নেয়। আমার কাজে এটাই এসেছে। আসলে যারা এর সমালোচনা করেন তাদেরকে চলচ্চিত্র দর্শন বুঝতে হবে। যে চরিত্র যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাতেই কথা বলতে দিতে হবে।
আনিসুল হকের সঙ্গে আপনার জুটির প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতে চাই। একই লেখকের পান্ডুলিপি নিয়ে বার বার কাজ করলে কি কাজের বৈচিত্র কমে যায়?
না। আসলে আনিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা খুবই ভাল। আমরা দু’জন একই রকম চিন্তা করতে পারি। তাই বার বার তার সঙ্গেই কাজ করি।
আপনার অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনেও নতুনত্ব ছিল। আপনি অনেক অপেশাদার শিল্পী নিয়ে যেমন কাজ করেছেন তেমনি একই মুখ বারবার দেখা গেছে।
আমার কাছে যাকে যে চরিত্রের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছে তাকেই নিয়েছি। সেকি টিভি নাকি সিনেমার- এটা আমার কাছে কোন বিষয় না। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি- ‘বিড়ালটা সাদা নাকি কালো সেটা কোন ব্যাপার না, ব্যাপার হলো বিড়ালটা ইঁদুর মারতে পারে কি না।’
আপনার আর একটা ব্যাপার ছিল ‘ভাই-বেরাদার’ গঠন। ছবিয়াল উৎসবে যাদের ছবি প্রচারিত হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব হল?
আসলে এখানে দল গঠনের কোন ব্যাপার নেই। যারা বিভিন্ন সময়ে আমাকে কাজের জন্য ‘যন্ত্রণা’ করছিল তাদেরকে নিয়েই একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছিলাম আর কী!
একটা কথা অনেকেই বলে সব ভাই-বেয়াদারের কাজই আপনার মতো হয়ে যাচ্ছে।
এটা তো হবেই। তারা তো সবাই একই স্কুলের ছাত্র। স্কুলিং-এর একটা ব্যাপার তো থাকবেই, গুরুর ছাপও থাকবে।
নতুন যারা কাজ করছে তাদের মধ্যে কার কার কাজ আপনার ভাল লাগে?
অনেকেই। অনেকেই আছেন, নাম বললে কেউ বাদ পড়ে যেতে পারেন। তাই নাম বলতে চাই না।
নতুনদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ, তারা কিছু না শিখেই কাজে নেমে পড়ছে। তাদের কাজের নিদের্শনা দেয় আসলে ক্যামেরাম্যানরা।
এটা একদমই সত্যি না। বরং এটা আগের পরিচালকদের জন্য ভীষণভাবে সত্যি, যারা সবকিছু ক্যামেরাম্যানের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতেন। নতুনদের মধ্যে এর সংখ্যা একবারে হাতেগোনা।
বাংলা ভাষাতে বাংলাদেশের বাইরে কলকাতাতেও ছবি হচ্ছে। ওদের ছবি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
আসলে আমার কোন ধারণা নেই। তাই কোনো মন্তব্যও নেই।
আপনার ছবি তো কলকাতাতেও অনেকবার দেখানো হয়েছে। প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
খুবই ভালো। ওদের ছবি তো সব কোষ্ঠকাঠিন্য ভরা। এত জীবনঘনিষ্ঠ ছবি তো ওরা ভাবতেই পারেনি। সবাই প্রশংসা করেছে।
আপনার নিজের ছবি তো শুধু দেশের দু’একটা সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে। এতে করে দর্শক সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে না?
সেটা হচ্ছে। কিন্তু আমি এখনো সব দর্শক কিংবা গ্রামের দর্শকের জন্য ছবি বানাইনি। এজন্য দুঃখিত অথবা গর্বিত হবার কিছু নেই।
কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, “শহরে অনেক রকম মানুষ থাকে, একটা ছবি দিয়ে যাদের সবাইকে ধরা সম্ভব না”। আপনি নিজের ছবি দিয়ে আসলে কাদের ধরতে চান?
এটা আসলে একেক কাজের জন্য একেকরকম। প্রত্যেকটা কাজ তার চরিত্র ও বক্তব্য অনুযায়ী সেই ধরণের মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। এটা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।
এখন টিভিতে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এতেও কি দর্শক সীমত হচ্ছে না?
আসলে পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক ছবি টিভিতে আগে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু টিভির ছবির বড় সমস্যা বিজ্ঞাপন। এতো বিজ্ঞাপন যে দর্শক বিরক্ত হয়ে যায়।
সিনেমা নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন?
আমি দেখি- আর কয়েক বছর পরেই অসংখ্য নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা সিনেমা বানাবে। তারা শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ, দারিদ্র কিংবা হতাশামূলক বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে বিচিত্র সব বিষয়ে ছবি বানাবে।
0 comments:
Post a Comment